-আব্বা! আপনার কাছে কি দুই লাখ টাকা হবে?
-ক্যাশ? না অত টাকা নেই!
ব্যাঙ্কে পেনশনার সঞ্চয়পত্র করা আছে কিছু,এই মুহুর্তে ভাঙ্গলে লস হবে!
-আমি না হয় লসটুকু কাভার করে দিতাম,অনেক বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য চাইছি আব্বা।
-মবিনুর! আমি বৃদ্ধ পেনশনার মানুষ এই সামান্য কয়টা টাকা নেড়েচেড়ে খাই,
রোগে চিকিৎসা করাই,শুকরিয়া কর যে তোমাদের দুই ভাইয়ের কাছে হাত পাততে হয়না। রিটায়ার্ড লাইফে সন্তানের কাছে হাত পাতা যে কি লজ্জার সে তুমি বুঝবে না।
-আব্বা! স্বল্প আয়ের পুত্র সন্তান হওয়া কত কষ্টের তা যদি আপনি জানতেন।
-তুমি অত টাকা দিয়ে কি করবে?
মবিনুর রহমানের বুকটা হু হু করে উঠল।
একই বাসায় দুই ভাই
মবিনুর,আবিদুর,বাবা মমিনুর রহমান উপরে নীচে বসবাস করেন। বাবা ছোট ভাই আবিদুরের সাথে দু’তলায় আর মবিনুর রহমান তিন তলায় থাকেন।
ছোট ভাইয়ের এক ছেলে এক মেয়ে।
সিএন্ডএফ এজেন্টের ব্যবসা আবিদুরের।
প্রচুর কাঁচা পয়সা! আবিদুরের এই কাঁচা পয়সার রহস্য মবিনুর রহমানের অজানা।
মাসের প্রায় সময়ই বর্ডার এলাকায় পড়ে থাকে আবিদুর! ছোট ভাইয়ের কাছে টাকা ধার চাইতে মবিনুরের সেই আপত্তি;
তাছাড়া আবিদুর সময়মত রেসপন্স না করলে ব্যাপক শরম।
মবিনুর,স্ত্রী রুমানা আর ছয় বছর বয়সী একমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী পুত্রকে নিয়েই তার সংসার। পরীবাগের তিন তলা বাড়িটি তার দাদার করে যাওয়া।
এক বাড়িতে বাস করেও বাবা মমিনুর রহমান জানেন না মবিনুরের এত টাকার কি প্রয়োজন!
-আব্বা! সায়েমকে নিয়ে একটু ইন্ডিয়া যেতে চাইছিলাম। ছেলেটার কষ্ট আর সহ্য হয়না।
-কত চিকিৎসাই তো করালে কোন উন্নতি হলো? এলোপ্যাথি,হোমিওপ্যাথি,কবিরাজি,ঝাড়ফুঁক,তাবিজ তুমার কিছুতেই কিছু হলো না;উল্টো বছর বছর ঋনে জড়ালে।
-আরেক বার শেষ চেষ্টা করে দেখি
-আমি তোমায় এক শর্তে টাকা দিতে পারি!
-আব্বা! আমি আপনার সব শর্তেই রাজি।
-রাতে আমার শয়ন কক্ষে দেখা কর;
বৌ’মাকে সঙ্গে আনার দরকার নাই!
মবিনুর রহমান আজ ইন্ডিয়া যাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধী ছেলে সায়েমকে নিয়ে তিনি একাই যাচ্ছেন। স্ত্রী রুমানা যেতে চেয়েছিলেন। টাকা পয়সার টানাটানিতে যেতে পারলেন না।
আজ সকাল দশটায় বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা টু কোলকাতা;ওখানে আজকের দিনটা থেকে আগামীকাল বিমানে অ্যাপোলো হসপিটাল,গ্রীমসরোড,চেন্নাই। ঢাকা থেকে আগে ভাগেই অনলাইনে সব এপোয়েন্টমেন্ট কনফার্ম করে রেখেছিলেন মবিনুর।
একটা বেসরকারি ইন্ডেন্টিং ফার্মের এজিএম মবিনুরের সংসার চলে বেশ টানাটানির মধ্য দিয়ে। সততা ও সরলতার জন্য ধান্ধাবাজি করাও শিখেন নাই তিনি! চেন্নাই পৌঁছে পরদিন থেকেই শুরু হলো ডাক্তারের কাছে দৌঁড়াদৌঁড়ি। প্রতিদিন নিয়ম করে ডাক্তার দেখানো,ওয়াকিং টেস্ট,নার্ভ টেস্ট,স্টেন্থনিং টেস্ট,ব্লাডের বিভিন্ন প্রকারের টেস্ট,ইউরিন টেস্ট, সবশেষে এম আর আই।
পনের দিন পর যেদিন রিলিজ হচ্ছে,
ডাক্তার প্রশান্ত আগরওয়াল বললেন-
-মিঃমবিনুর! বাংলাদেশেও তোমার ছেলের সঠিক ট্রিটমেন্টই হয়েছে! আমি বুঝতে পারি পিতার মন মানে না তাই তুমি ছেলেকে নিয়ে হিন্দুস্তান চলে এসেছো।
লুক মিঃমবিনুর…………!
এর পরের বাক্যগুলো মবিনুর রহমান আর শুনতে চান না,গত চার বছর ধরেই এসব শুনে আসছেন-আল্লাহ সহায় হলে তোমার ছেলে ভাল হয়েও যেতে পারে,ইত্যাদি ইত্যাদি! এসব আর ভাল লাগেনা। তার কান্না পাচ্ছে ভীষন কান্না।
বড় আশা করে পুত্রকে নিয়ে ইন্ডিয়া এসেছিলেন।
পরীবাগের বাসার তিন তলার বারান্দায় রুমানা বেগম অস্থির পায়চারী করছেন।
আজ পনের দিন হয়ে গেল স্বামী মবিনুর বাসায় নেই। বারো বছরের বিবাহিত জীবনে একরাতের জন্যও রুমানাকে একা ঘুমাতে হয়নি। আজ পনেরদিন এই লোকটা নাই। ঘরটা কেমন খালি খালি লাগে।
তার ঘুম আসেনা;অথচ স্বামী পাশে থাকলে আপোষে ঘুম এসে যায়,গভীর ঘুম। এই অসম্ভব ভাল লোকটা না থাকলে রুমানা চলবে কি করে? তার মাথা ভার হয়ে আসে।
পুত্র সায়েমের জন্য তার কেবলই পেট পুড়ে! তার ছেলেটি হাঁটতে পারেনা।
এই হাঁটতে না পারা ছেলেটি তাকে সারাক্ষন কাঁদায়। রুমানার খারাপ লাগে যখন কাছের আত্মীয় স্বজনও এই প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য ওদের দাওয়াত দেয়া বন্ধ রেখেছে।
এমন সময় হোয়াটস আপে কল এলো।
-রুমানা ভাল আছো তো?
উত্তেজনায় রুমানার গা কাঁপছে!
মাত্র মবিনুরের কথা মনে করেছেন তিনি।
অনেক দিন বেঁচে থাকুক লোকটা।
-আলহামদুলিল্লাহ! তোমরা ভাল আছো তো?
-হুম।
-সায়েম? কি বলল ডাক্তার?
-ও ভাল আছে! অনেক কথা আছে দেশে এসে বলব। সায়েম কে ওর মেডিকেল বোর্ড লং টার্ম ফিজিওথেরাপির পক্ষে ওপিনিয়ন দিয়েছে! এমনিতে ওর অন্যান্য রিপোর্ট ভাল।
-তোমরা আসছ কবে?
-আরো দিন পনের সময় লাগবে!
-হায় আল্লাহ! কেন?
-আমার ছোটখাটো একটা অপারেশন হবে-কাল! পাঁচ সাতদিন হসপিটালে থাকতে হবে,ছাড়া পেয়েই চলে আসব!
-কি অপারেশন মবিন? তোমার আবার কি হলো?
ওপাশ থেকে আর কোন উত্তর শোনা গেলনা।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার এক মাস পর মবিনুর রহমান দেশে ফিরলেন।
তার ওজন অনেক কমে গেছে।
আগের মত আর ঝটপট নড়াচড়া করেন না তিনি। ছেলেটাকেও আগের মত কোলে নিতে পারেন না;বেশ ভারি লাগে।
অপারেশনের জায়গায় ব্যথা করে।
রাতে গা গরম,জ্বর জ্বর লাগে।
ইন্ডিয়া গিয়ে মবিনুরের একটা ভাল লাভ হয়েছে! তার হাতে এখন প্রচুর টাকা!
বাবার দুই লাখ টাকা শোধ করার পরও বেশ ভাল একটা এমাউন্ট হাতে থেকে যাবে!
রাতে বাবার শয়ন কক্ষে মবিনুর বসা!
পায়ের কাছে নত মস্তকে বসে থাকা মবিনুর রহমানকে অনেক পূণ্যবান একজন মানুষের মত লাগছে!
-মবিনুর!
-জি আব্বা!
-তোমার শরীর কেমন?
-আব্বা! আপনার টাকাটা ফেরত দিতে আসলাম !
-হোয়াট? এত টাকা তুমি কোথায় পেলে? মমিনুর রহমান বিছানায় উঠে বসলেন।
-আব্বা! আপনার শর্ত আমি মানতে পারিনি তাই টাকাটা ফেরত দিতে আসলাম।
-তার আগে বল তুমি টাকাটা পেলে কোথায়?
-আব্বা! দুনিয়া অনেক কঠিন একটা জায়গা নো ডাউট;এত যে কঠিন তা জানা ছিল না। আপনি বলেছিলেন প্রাচীন কালে জাপানীরা একটা উৎসব করত।
হারিকিরি নামের সেই উৎসবে কদাকার,রোগী,বিকলাঙ্গরা স্বেচ্ছায় পেটে ধারাল ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করত! সমাজকে সুন্দর ও ব্যাধিমুক্ত রাখতে এটা তারা করত।
আপনি আমাকে সেই আদলে আমার বিকলাঙ্গ পুত্র সায়েমকে ইন্ডিয়ার কোন জনাকীর্ন রেল বা বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে আসার বুদ্ধি দিলেন। অপারগতায় কোন অনাথ আশ্রমে ফেলে আসতে বললেন!
আমি পারলাম না আব্বা,পারলাম না।
আপনার পুত্র আপনার দায় হতে পারে;
আমার পুত্র আমার দায় নয়-সম্পদ।
দোয়া করবেন আব্বা।
মবিনুর রহমান দু’টো এক হাজার টাকার বান্ডিল অতি বিনয়ের সাথে বাবার মাথার কাছে রেখে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
-মবিনুর! বাবা ডাকলেন। আমার উপর রাগ করে তুমি তোমার একটা কিডনি বেচে দিলে?
মবিনুর রহমান যেমন দ্রুত যাচ্ছিলেন তেমনই দ্রুত ফিরে আসলেন।
বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাবার বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লেন।
-আব্বা! আর কোন উপায় ছিল না আমার। ভাল অফার পেলাম-বেচে দিলাম। রুমানা জানে আমার হার্ণিয়া অপারেশন হয়েছে!
মমিনুর রহমান বিলাপ করে করে কাঁদছেন-
-মবিনুর রে……মবিনুর!
~সাইফুল আলম