হাওর বাওর লালনের দেশ, ভালোবাসি এই বাংলাদেশ। আমাদের এবারের গন্তব্য সিলেটের সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। ঢাকা থেকে ভ্রমণ পিপাসু আটজন গিয়েছিলাম এই সফরে। আমার সাথে ছিলো আমার সহকর্মী যোবায়ের ভাই, শহীদ ভাই, টিপু ভাই, অমিত। এছাড়া আরও ছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই, নাহিদ ভাই ও রায়হান ভাই। সচরাচর টুরিস্টরা যে পথে টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে থাকেন সে পথে আমরা যাইনি। সাধারণত সবাই সুনামগঞ্জ হয়ে আসেন। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ আসেন বাসে করে তারপর অন্য ট্রান্সপোর্ট এ আসেন তাহিরপুর উপজেলায়। কিন্তু আমরা বেছে নিয়েছিলাম ভিন্ন এক পথ। ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই আমাদের এ পথ বেছে নেয়া। ৯ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবার রাত ১০ টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে প্রথমে এসেছি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে। পরে সেখান থেকে আমরা অটো রিকশায় এসেছি সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে। আর মধ্যনগর থেকেই আমাদের আজকের জার্নি শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওরে। আগে থেকেই ঠিক করা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় আমরা এবার ভ্রমণ করছি। এক রাত দুই দিনের জন্য ভাড়া ছিলো এগারো হাজার টাকা। ও ভালো কথা এর মধ্যে বাবুর্চি সহ খরচ ছিলো।
ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি হচ্ছে সুন্দরবন। এই হাওরে আমাদের এবারের সফর এক রাত দুইদিন। সেভাবেই আমাদের বোট ভাড়া করেছি। আমরা ভ্রমণকারী আটজন ও বোটের মাঝি ও বাবুর্চি মিলে মোট ১২ জন আছি এই সফরে। আমরা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে আসলেও অগ্রিম বর্ষায় থৈ থৈ করছে পুরো এলাকা। চারদিকে যেনো এক বিশাল জলরাশি। বিশাল পানির প্রান্তর আমাদের যেনো স্বাগত জানাচ্ছে। এতো জলরাশি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
ভাসতে ভাসতে এবার আমরা চলে এসেছি টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম টুরিস্ট স্পট ওয়াচ টাওয়ারে। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে তাকালে এক অপরুপ দৃশ্য চোখে পড়ে। পানির ভেতরে জেগে থাকা সোয়াম ফরেস্ট দেখে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন অন্য এক জগতে। আর ওয়াচ টাওয়ারের আশে পাশে স্বচ্ছ পানিতে গোসল করার মজাই অন্য রকম। আমরা সেখানে গোসল সেরে নেই সবাই। ওখানে পানির গভীরতা কিন্তু কম নয়। তাই গোসলে লাইফ জ্যাকেট পড়তে ভুলিনি আমরা। আমাদের এরপরের গন্তব্য ট্যাকেরঘাট। সেখানে আমাদের নৌকা নোঙ্গর করবে। আমরা আজ রাত সেখানে এই বোটেই রাত যাপন করবো এবং আশে পাশের কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখবো। শিমুল বাগান, যাদুকাটা নদী, বারিক্কাটিলা থেকে মেঘালয়ের পাহাড়, নীলাদ্রি লেক ও লাক্মাছড়া দেখার প্ল্যান আমাদের।
ট্যাকেরঘাটে নেমেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি স্পটগুলো দেখতে। ভাড়া করা বাইকে আমরা ঘুরতে বের হই। প্রথমে যাই শিমুল বাগানে। সেখানে নদী পারাপারের একটা বিষয় থাকাতে আমরা দূর থেকেই শিমুল বাগান দেখে চলে আসি। বারিক্কাটিলাতে আমাদের অবস্থান এখন। বারিক্কাটিলা থেকে মেঘালয়ের বড় বড় পাহাড় আর ঝর্ণা চোখে পড়ে। নীচে যাদুকাটা নদী। টিলার ওপর বসে নদী ও পাহাড়ের মিলনমেলা দেখে আমরা অভিভূত।এই স্নিগ্ধ বিকেলে এতো সুন্দর জায়গায় বসে পাহাড় ও নদী দেখে মন জুড়িয়ে গেলো। আর এভাবেই ভালো ও সুন্দর সময় যে কিভাবে পার হয়ে গেলো তা টের পেলামনা আমরা। এরপর আবার সেই বাইকে চেপে চলে আসি নীলাদ্রি লেকের পাশে। একসময় এখানে চুনা পাথরের খনি ছিলো। এখন এই জায়গা পরিত্যক্ত। আগের কিছু ভাঙা স্থাপনা এখনো আছে। নীলাদ্রি লেকের পাশে উঁচু টিলায় বসে আমরা এক অখন্ড সময় কাটালাম। খুব ভালো লাগলো নীলাদ্রি লেকে বসে থেকে শেষ বিকেলটা কাটাতে।
তারপর আমরা সন্ধ্যায় স্থানীয় বাজারে চা নাশতা সেরে নেই। ছোট ছোট দোকানে গরুর দুধের চা পাওয়া যায়। সাথে মিষ্টি দই ও রসমালাই। খেতেও খুব একটা খারাপ না। ও ভালো কথা এখানকার দোকানগুলোতে মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা ছিলো। প্রতি ফোন দশ টাকা। এরপর নৌকায় আগে থেকে বাজার করে দেয়া হাঁস ভুনা দিয়ে রাতের খাবার সেরে নেই আমরা। ট্যাকেরঘাট থেকে ভুমি থেকে একটু দূরে আমাদের নৌকা নোঙর করা হয়। তারপর জোসনা রাতে ভাসমান নৌকায় রাত যাপন করি সবাই।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে মাঝিদের ডাকে। স্নিগ্ধ সুন্দর এক সকাল। আমাদের সকালের নাশতা ছিলো খিচুড়ি ও ডিম ভাজি। পরে স্থানীয় বাজার থেকে হাওরের মাছ কিনে আনি আমরা। ছিলো কাতল, মৃগেল, শিং, ট্যাংরা, বাইম সহ আরও কিছু মাছ। আমাদের এখনকার গন্তব্য আরেকটা সুন্দর স্থান লাকমা ছড়া। যেটি বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত। সেখানে গিয়েতো আমরা আরও মুগ্ধ। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানি এসে পড়ছে বাংলাদেশের এই লাকমা ছড়ায়। নিচে পাথর ওপরে স্বছ শীতল পানি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সেখানে আমরা গরমে একটু হাপিয়ে উঠি। ভাগ্য ভালো সেখানে আমরা লেবুর শরবত পেয়ে যাই স্থানীয় দোকানে।
এখন আবার হাওরের বুকে আমাদের নৌকা ভাসানোর পালা। আমরা আবারও ওয়াচ টাওয়ার দেখতে যাবো এবং আবার গোসল করবো। হাওরের মাছ যে এতো টেস্টি আমরা আজকে দুপুরের খাবার না খেলে বুঝতাম না। অসাধারণ সব খাবার খেলাম আমরা। কাতল মাছ ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, গুড়া মাছের কারি খেয়ে আমরা সত্যি অভিভূত। আর এভাবেই কেটে গেলো আমাদের সুন্দর এক সফরের দুই দিন। অনেক স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই সফর। ভ্রমণে মনের দড়জা খুলে যায় তাই বেড়িয়ে পড়ি ঘর থেকে দূরে বারবার।
~অলিউর রহমান খান