জাহিদ সকাল বেলা এসে কলেজের উল্টো দিকের বইয়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করছে, দুই বোন হলের নিচে নামলেই রওনা হবে!

কলির হাতে ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে এসে ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে।

জাহিদ বললো পলি কোথায়?
– আপা, হলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। আর মেজ ভাই, ভাইজানের বাসায় যেতে হবে তো!
– এখন?
– হ্যা, মায়ের শাড়ি নাকি কিনবেন, আজ নিয়ে যেতে বলেছেন।
– এখন ওই বাসায় যেতে ইচ্ছে করছেনা, কিন্তু মায়ের শাড়ি, যেতে তো হবেই।
– হুম, আমরা বসবো না, তাড়াতাড়ি করে বেড়িয়ে যাবো। কখন বাড়ী যাবো সেই আশায় আছি।

তিন ভাই-বোন শারমিনের বাবার বাড়ী গেটে নামতেই দেখলেন এক ফেরীওয়ালা বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে।

শারমিন দেখেই বললো কেমন আছ তোমরা?
– ভালো আছি ভাবী, জিহান কোথায়?
– আইরিন ছাদে নিয়ে গিয়েছে, রোদের মধ্যে গোসল করাবে আম্মা।

তারিন এসে বললো আপা, তুই আবার কি কিনলি ফেরীওয়ালার কাছ থেকে?
– না, না। কিছু না, আম্মা বুয়ার জন্য শাড়ি কিনেছে। – – – আম্মা তো ছাদে
– আরে, যাওয়ার আগে কিনেছে।
– তোর হাতে সাদা মতন একটা শাড়ি না দেখলাম।
– আরে না!
– তবে, আপা তুই আম্মাকে যে শাড়ি আড়ং থেকে দিয়েছিস! কি সুন্দর কালার! আমি সেটা পরে র‍্যাগ ডে তে যাবোই।
– আচ্ছা যাতো এখন! শুধু শুধু বেশি কথা বলিস।

শারমিন তাড়াতাড়ি করে বললো কলি দাঁড়াও আমি মায়ের শাড়ি নিয়ে আসছি।
– জি ভাবী।

শারমিন সুন্দর করে আড়ং এর প্যাকেটে শাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর বলছে, তোমরা কি এখন বসবে কলি?
– না ভাবী! জিহান কে এক্টু আদর করেই চলে যাবো।
– আরে, আইরিন তেল মাখিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তুমি কোলে নিলে আরও জামায় লাগবে। বাড়ীতে যখন যাবে, রওনা হয়ে যাও।
– জি ভাবী।

পলি বাসা থেকে বেড়িয়েই কলিকে বকছে, আমি একদিন বলেছি না, অতিরিক্ত আবেগ দেখাবিনা!
– কি দেখালাম?
– জিহান কে আমরা আদর করি, ভাবী পছন্দ করেন না! বুঝিস না কেন?
— নিজের ভাইয়ের ছেলে, আদর করবো না?
– আচ্ছা বাদ দে, কথা বেশি বলার দরকার নাই।

পলি গাড়ীতে বসে ভাবছে, ভাবী আজ সকালে বাসা থেকে বের হোন নি, ভাইজান অফিসে অথচ শুধুশুধু আড়ং এর ব্যাগে কেন মায়ের শাড়ি দিলেন! তারিনের কথাই ঠিক ভাবী ফেরীওয়ালার কাছ থেকেই শাড়ি কিনেছেন! আবার কাল বললেন উনার মায়ের শাড়ি উনি পরে কিনবেন। শাড়ি কিনেছেন ভালো কথা,মিথ্যা বলার কি দরকার! কেন যে এই ছোটলোকি কাজ গুলি করেন, কে জানে! শাড়ি ফেরীআলার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে, কলি বুঝে নাই তাই ভালো। জীবনে যারা কম বুঝে তারাই ভালো এবং শান্তিতে থাকে।

জাহিদ বললো কি রে কি ভাবছিস?
– কিচ্ছু না।
– রোযা থাকতে পারবি তো?
– তুমি রাস্তায় সেহরী খেয়ে দুই বার যাওয়া আসা করে থাকতে পারছো, আর আমি পারবো না কেন?

জাহিদ হাসছে…

ইফতারের দশ মিনিট আগে এসে বাড়ীতে পৌছে গেল কলি-পলি। দুই বোন দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছে৷

রাহেলা খানম বলছেন যা কল পাড়ে, হাত মুখ ধুয়ে ওযু করে আয়, আযান হয়ে যাবে, যা!

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর, তাদের বাড়ীর বড় খাটে দুই বোন মায়ের দুই পাশে বসেছে, জাহিদ খাটের এক কোনে, পুরোনো কথা আলোচনা করে হাসাহাসি করছে সবাই। পলির বারবার মনে হচ্ছে আজ কে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এতো আনন্দ লাগছে, কোন ক্লান্তিই আর যেন লাগছেনা!

রাহেলা বললেন বাবা জাহিদ জলির বিয়ের পর প্রথম ঈদ জামাইকে আর ওকে কিছু দেওয়া তো লাগবে।
– দিবা, সমস্যা কি?
– সমস্যা টাকা।
– টাকার সমস্যা সবারই আছে, কোটিপতির ও আছে, কিন্তু ম্যানেজ দিতে হবে। এখন বলো কি দিতে চাও?
– একটা পাঞ্জাবী, আর জলির জন্য একটা শাড়ি। আমার জন্য কিচ্ছু লাগবেনা বাবা।
– জলিপার কথা মাথায় আছে মা।
– সাঈদ শাড়ি দিল কেন আমাকে? আমি কি ছোট বাচ্চা যে ঈদে নতুন কাপড় লাগবে!

কলি বললো ভাইজান বোনাস পেয়েছে, দিবেনা কেন?
– ভাইজান যখন নতুন চাকরি ছিল তখন ও তোদের দিয়েছে।
– গজ কাপড় দিয়েছে তাও ঈদের আগের রাতে। তুমি সারারাত সেলাই করে সকালে দিতে।
– আর উপায় কি ছিল? তাও করেছে তো।
– আমরা কি কখনো আবদার করেছি মা? যা দিয়েছে তাতেই খুশি।নাহিদ কে ভাইজান টেনে পড়ার সময় ঈদে একটা বই কিনে দিয়ে বললো যা এটা তোর ঈদ উপহার। তাও তো মন খারাপ করেনি।
– সবুরে মেওয়া ফলে। আমার নাহিদ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে একদিন আমার নাহিদের ও কাপড়ের অভাব থাকবেনা।
– তাই যেন হয় মা!

ঈদের আগের রাতে শাহিদ-নাহিদ এসে বাড়ীতে পৌছালো দুই বোনের জন্য সেন্ডেল, মায়ের জন্য ব্লাউজ পিস, সেমাই-লাচ্ছি নিয়ে।

রাহেলা দুই ছেলের মুখে হাত দিয়ে আদর করছেন, আমার সোনা পুত্র তোরা মায়ের কাছে চলে এসেছিস, আজ আমার ঘরে শুধুই আনন্দ। এগুলো কেন এনেছিস বাবা, মায়ের সবই আছে।

শাহিদ বলছে, নাহিদ তো তোমার জন্য শাড়ি কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু বাজেট নেই, তাই হলো না। তবে আগামী বার অবশ্যই কিনে আনবো।
– এই ব্লাউজ পিস ই তো আমার জন্য হীরা। শাড়ি লাগবেনা।

পলি-কলি দুই বোন স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে দেখছে আর হাসছে। কি সুন্দর পাথর বসানো স্যান্ডেল।

নাহিদ বললো আপা পছন্দ হয়েছে?
– খুব খুব।
– আমরা দুইজন লটারী করে কিনেছি। কারণ আরেক জোড়া আমাদের পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু কোন টা নিব ভেবে ভেবে পরে লটারী করে নিয়ে এলাম। টাকা থাকলে দুই জোড়া করে নিতাম।
– খুউব সুন্দর হয়েছে। তুই নিজের জন্য কিছু কিনেছিস?
– আমার নতুন শার্ট আছে, আর কিছু লাগবেনা।

দুই বোনের মুখ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে সাথে সাথে। কি! তুই আর শাহিদ কিচ্ছু কিনিস নি?
– আরে না।
– তাহলে কেন আমাদের জন্য আনলি?
– আরেকবার ঈদে দেখবো তুই ও জলিপার মতো চলে যাবি, এরপরে কলিপা ও চলে যাবে। তোমরা এখন ঘরে আছ, আনন্দ করে নাও। আমরা পরার মতো কত সময় আছে।

দুই বোন ভাইয়ের কথা হা করে শুনছে। ছোট্ট নাহিদ কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে। ত্যাগ করেও যে কত আনন্দ পাওয়া যায়, তা শুধুমাত্র বড় পরিবারের ভাই-বোন গুলোই জানে। নিজে না কিনেও নাহিদ বোনেদের দিয়ে কত খুশি।

ঠিক রাত দশটায় দুই বোনের জন্য মেহেদী আর চুড়ি আর তিন ভাইয়ের জন্য লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী নিয়ে উপস্থিত হলো জাহিদ। এসেই বললো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর উপহার! এই এগুলো ওয়ান টাইম রে। এক ধোয়া দিবি দেখবি রঙ শেষ। কিন্তু ঈদ চালিয়ে নেওয়া যাবে। তাই নিয়ে এলাম।

শাহিদ হাসছে আর বলছে এটা তো দারুন রে মেজ ভাই। এইটা না ধুয়ে আরও দুই ঈদ পার করা যাবে,কি বলিস নাহিদ।
– হ্যা, চমৎকার চমৎকার হয়েছে।

ঈদের দিন সকাল বেলা সবাই নামাযে যাওয়ার পরে পলি-কলি সুন্দর করে জামা পরে, স্যান্ডেল জোড়া পরে নিল। কারণ এই বার প্রথম তারা ঈদে নতুন স্যান্ডেল পেয়েছে।

পলি দেখলো রাহেলা খানম আঁচল দিয়ে বার বার চোখ ডাকছেন।

পলি গিয়ে বললো কি হয়েছে মা?
– কিচ্ছুনা রে!
– জলিপার জন্য মন খারাপ করছে?
– আমার জলি ছাড়া এই বার প্রথম ঈদ। আমার সাঈদ গত ঈদেও আসেনি, এবার ও এলো না! আর কি ঈদে আমার ছেলে বাড়ী আসবেনা?
– মা, অবশ্যই আসবে। ছেলে ছোট, ছুটি নেই, তাই আসেনি।
– ঈদের দিন দুটি ছেলে-মেয়ে নেই, বুক টা কেমন যে লাগছে।
– মাগো এখন তোমার, মেজ ভাই, শাহিদ-নাহিদ আসবে, নামায পড়ে। তুমি কান্নাকাটি আর কর না, ওদের জন্য অনেক দোয়া কর যেন, একদিন অনেক বড় বাড়ী এরা করতে পারে, ভাবী যেন নিজের ইচ্ছায়ই ভাইজান কে নিয়ে আসেন।
– আমার চার ছেলে আর তিন মেয়েকেই যেন আল্লাহ সব সময় ভালো রাখেন আর সুস্থ রাখেন, এই দোয়া সবসময় করি।

পলি রুমে এসেও দেখছে রাহেলা খানম আবার ও চোখ মুছেই যাচ্ছেন। মায়ের অনেক সন্তান থাকলেও একজন সামনে না থাকলে মায়ের কত খালি খালি লাগে, শুধু সেটা মা জানেন।

রাহেলা খানমের খুব কষ্ট লাগছে সাঈদের জন্য। জলির জন্য ও মন খারাপ, এই মেয়ে ঈদের সকালে সব কিছুতে মায়ের সাথে সাথে থাকতো অথচ আজ সে শ্বশুরবাড়ী। সাঈদ তার তিন সন্তান মারা যাওয়ার পর একমাত্র আদরের পুত্র ছিল, আজ সে পুত্র ও মাকে ছাড়া ঈদ করছে, জীবন খুবই বিচিত্র খুউব…

কলি এসব কান্নাকাটি দেখে তার ও মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু সে বার বার বাড়ীর বাইরের দিকে দেখছে তার তিন ভাই লাল পাঞ্জাবী পরে যখন ঘরে ঢুকে মাকে সালাম করবে, তখন আবার আনন্দে ঝলমল করবে বাড়ী, মায়ের মন তাড়াতাড়ি ভালো হওয়ার জন্য কলি ভাইয়েরা আসছে কিনা, আবারও বাইরে দিকে দেখছে….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
২১.১২.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}