আজ সকালে জাহিদ এসেছে বাসায়, সাথে বস্তা ভর্তি জিনিস পত্র। খুব ভোরে এসে পৌছেছে বাসায়।

ভাই-বোনের মধ্যে জাহিদ চতুর্থ। জাহিদ এবার ডিগ্রি ২য় বর্ষে পড়ছে। গ্রামে বেশ কয়েকটি টিউশনি পড়ায়, চাকরীর জন্য পড়াশোনা করে যাচ্ছে। য্যাতে ডিগ্রি পাশ করার পর আর বসে থাকতে যেন না হয়। সব মিলিয়ে যা টাকা পায়, তা দিয়ে শাক-লতা পাতা দিয়ে কোন রকম টেনেটুনে সংসার চালায় সে।

কলি ভাইয়ের একদম পাশে বসে আছে। তার আজ খুব আনন্দ লাগছে মেজ ভাই বেড়াতে আসায়।

পলি বললো মেজ ভাই এই এতো বড় বস্তায় কি?
– তেমন কিছু না, সামান্য তরি তারকারি। আর বাদামের টানা, নিমকি, সরিষার তেল। এই টুকটাক কিছু জিনিস।
– কেন? এতো কষ্ট করে এগুলো আনলে? কত দূরের রাস্তা, এই বস্তা নিয়ে কত কষ্ট হয়েছে।
– টাকা থাকলে তোদের জন্য আর কিছু জিনিস পত্র কিনে আনতাম।
– থাক, আর লাগবেনা।
– ভাইজান কোথায়?
– ঘুমে।
– ওহ, এখন সাতটা বাজে মাত্র।

নাহিদ বললো পলিপা, মেজ ভাইরে চা-বিস্কুট কিছু দেয়! সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছে।
– হ্যা, হ্যা।

নারে নাহিদ, পলিপা কে কিচ্ছু বলিস না, ও আনতে পারবেনা। ভাবী রাতে মিট সেইফ তালা দিয়ে ঘুমিয়েছে।

জাহিদ বলছে৷ আরে না। আমার ক্ষিদে নেই। আহে বল, তোদের কলেজ কেমন চলছে।
– মা কি করছে?
– সারাদিন তোদের চিন্তা করে। তোরা কি করছিস? এই চিন্তায় অস্থির থাকে মা।
– আমরা কত দিন বাড়ী যাইনা! ছোট ভাই আর মেজ আপু কি করছে?
– ভালোই আছে। শাহিদ একবার বলে ডিগ্রিতে ভর্তি হবে, একবার বলে কেরানীর চাকরী হলেও চাকরী করবে। দেখা যাক কি হয়!

সাঈদ এসে দাঁড়ালেন বললেন কি রে কখন এসেছিস তুই?
– ভাইজান আধা ঘন্টা হবে।
– মা কেমন আছে?
– ভালো আছেন মা।
– এতো সাত সকালে আসিস কেন? দিনে বের হবি, বিকালে আসবি। রাতে জার্নি করাটা ভালো নয়।
– জি।
– আমি নাশতা দিচ্ছি, আর তোরা আস্তে কথা বল, তোর ভাবীর রাতে কেন যেন ঘুম হয়নি। আজ একবার ডাক্তারে নিয়ে যেতে হবে।

পলি বললো ভাইজান আমি নাশতা বানিয়ে দিচ্ছি।
– তুই কি নাশতা করবি?
– রুটি সবজি করি, বা খিচুড়ি।
– না, না। দরকার নাই ঝামেলার। আমি দিচ্ছি।
– ভাইজান।
– না বললাম, আর আস্তে কথা বল।

কলি বললো মেজ ভাই, ভাইজান ভাবীরে ভয় পায়, যদি রাগ করে এজন্য নিজে নাশতা বানাতে গেল। কি বানাবে আল্লাহ জানেন।
– থাক, কথা বলিস না। আর আমার এমন সাত সকালে আসা ঠিক হয়নি।
– অবশ্যই ঠিক হয়েছে।
– আস্তে কথা বল, পরে ভাইজান রাগ করবে।

সাঈদ চারটা ডিম সিদ্ধ দিল, চারটা মিডিয়াম সাইজের আলু। তারপরে এগুলি চারটা প্লেটে করে ওদের রুমে নিয়ে গেল। বললো এই জাহিদ তোমরা নাশতা করে নাও। ডিম আর আলু খাও, আর সাথে দুটি করে কাঁচামরিচ খাও। দেখবে খুব ভালো নাশতা হয়েছে। এগুলো হলো খুবই স্বাস্থ্যকর নাশতা।
– জি ভাইজান। আপনি নেন।
– আমি একটু পরে খাবো। আর বস্তায় করে শাক-সবজি কেন নিয়ে আসিস? এখানে সবই মিলে। থাকবি কি আজকে?
– জি, কাল ভোরে রওনা হবো।
– আচ্ছা। রাতে কথা হবে, এখন যাই।

কলি বললো ভাইজান, একটু মুড়ি নিয়ে আসি?
– নিয়ে আয়।
– মিট সেইফ তালা দেওয়া।
– হ্যা, তোর ভাবী বলছিল, মারুফা নাকি বিস্কুট চুরি করে খায়, সেজন্য তালা দেওয়া। তোদের খেতে ইচ্ছে করলে ভাবীর কাছে চাবি চেয়ে নিস। উঠুক তোর ভাবী, তখন মুড়ি পাবি।
– জি ভাইজান।

সাঈদ রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর, পলি বললো এই তোর মুড়ি খাওয়ার এতো শখ কেন?
– এই আলু আর ডিম সকাল বেলা কেউ খায়?
– কেউ খায়না, তুই খাবি।

আচ্ছা, পলি বকিস না, আরেকবার আসার সময় আমি চিড়া মুড়ি বেশি করে নিয়ে আসবো। তোরা তোদের রুমে রেখে খেতে পারবি।
– না, না। লাগবেনা।

শারমিন ঘুম থেকে উঠেছেন দশটার সময়, উঠে তিনি মারুফাকে বললেন চা দিতে। তিনি চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললেন। আরে, জাহিদ কখন আসলে?
– ভাবী সকালে।
– ভালো হয়েছে, তুমি এসেছো। কলি কাল বলছিল ওর নাকি দুটি খাতা আর কি একটা বই লাগবে। এগুলি একটু কিনে দিয়ে যেও। তোমার ভাইজানের সময় নাই একদম!
– জি ভাবী দিব। আপনার শরীর কেমন?
– হুম ভালো আছি। বস্তায় কি?
– আমাদের ক্ষেতের শাক আর সবজি, শাহিদ এর হাতের জিনিস। আর মা সরিষার তেল, বাদামের টানা, আর নিমকি দিয়ে দিয়েছেন।
– আরে, শাক-সবজি কেন আনলে? এগুলো এখানেই পাওয়া যায়। ভাবলাম মাস্টার দেবর ভাবীর জন্য দই-মিষ্টি নিয়ে আসবে।
– আপনি দই খাবেন?
– আনলে খাবো না কেন? আর জাহিদ তুমি এভাবে বস্তায় করে জিনিস আনবেনা প্লিজ। এই পাড়ায় আমার আব্বার খুব পরিচিতি। আমাদের চেনে সবাই। কি বলবে দেখলে।
– আচ্ছা ভাবী। সমস্যা নাই।
– আমি একটু রান্নাঘরে যাই, সংসারে কত কাজ আমার!
– জি ভাবী।

পলি বললো ভাবী চলেন,আমিও যাই আপনার সাথে।
– আচ্ছা চলো।

কলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বলছে মেজ ভাই। কবে বাড়ী যাবো আমরা? আব্বা কেন মারা গেল?
– তুই কাঁদছিস কেন?
– এখানে আমার একদম ভালো লাগেনা। ভাবী সব সময় খুঁচিয়ে কথা বলে।
– ভালো রেজাল্ট করে, চাকরি করবি যখন, তখন এসব ভুলে যাবি। এখন আমাদের সময় টা খারাপ, ধৈর্য্য ধর, আর কি করবি?
– আমার খাতা লাগবেনা।
– আচ্ছা খাতা আমি কিনে দিব, সমস্যা নাই। কান্দিস না, মা শুনলে কত কষ্ট পাবে। এমনি সন্ধ্যা হলে তোর আর নাহিদের চিন্তা করে, কান্না করে শুধু।

নাহিদ এখন আগের মতো রাগ করেনা ভাইজান। এই যে এতো দূরের রাস্তা হেঁটে চলে যায়। সাইন্সে পড়ে, কত পড়া। এই যে সকাল আট্টায় যায়, আর দুপুর দেড় টা দুইটা বাজে আসে। এই পুরো সময় কিছুই খায়না। ভাবীর ভালো লাগলে উঠে নাশতা দেয়, নয়তো ভাইজান ডিম সিদ্ধ দেয়, তাই খেয়েই বেড়িয়ে যায় নাহিদ।

কলি, আমি একটু ভাবীর জন্য দই। আর তোর খাতা নয়ে আসি।
– একটু সময় বিশ্রাম নাও?
– না, সমস্যা নাই।

জাহিদ ভাইরে যাওয়ার সময়, শারমিন বললেন এই জাহিদ তোনার কাছে চল্লিশ টাকা হবে?
– জি ভাবী হবে।
– পলির কাছে দিয়ে দাও। আসলে ওদের ভাড়ার জন্য তোনার ভাই একশো টাকার নোট দিয়ে গিয়েছেন। তাই, ভাবলাম তোমার কাছে থাকলে তুমি দিয়ে দাও।
– আচ্ছা আমি দিচ্ছি।

পলি কাছে এসে বললো আজ কলেজ যাবো না। তুমি এতো দিন পরে এসেছো।
– না না। আমি আছি। যা তোরা কলেযে যা। এই নেয় চল্লিশ টাকা। আমার একটু কাজ আছে বাইরে। তোর কিচ্ছু লাগবে?
– না না।

জাহিদ রাস্তায় বেড়িয়ে দেখছে পকেটে যা টাকা আছে তাতে দই, আর কলির খাতা আর বই কেনার পরে যে টাকা থাকে, তাতে ট্রেনের একটা স্টেন্ডিং টিকেটের টাকা হবে। আর ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে। আবার পরে স্টেশন থেকে বাড়ী ও যেতে হবে হেঁটে। থাক, তবুও ভালো এদের কিছুব প্রয়োজনে টাকা লাগবে।

ভাবীর অভ্যাস সব সময় ভাইজানের কিছু কেউ কিছু চাইলেই অন্য কারোর উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার কাছে এক টাকার যে কি মূল্য সেটা কি ভাবী বুঝবে! না হয়তো বুঝবেন না।

জাহিদ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে এই যে চাকরি তুমি কোথায়? কবে দেখা দিবে? কলি, পলি আর নাহিদ কবে একটা ভালো পজিশনে যাবে? কবে মুক্তি পাবে এই সংসার থেকে! জাহিদ দই কিঞ্চহে আর ভাবছে ভাবীর হয়তো দই পছন্দ না ও হতে পারে। তবুও তিনি যেন খুশি থাকেন তাই চেষ্টা করছে জাহিদ….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
০৭.১১.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}