কলি দুই ঘন্টা ধরে কেঁদেই যাচ্ছে, চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে। ওড়না দিয়ে বার চোখ মুছে যাচ্ছে কলি।

রিতা খানম বললেন, এই কলি এরকম কেন কাঁদছো?
বোন মানেই তো এক বালিশে থাকলেও একদিন এক দেশেও থাকা হয়না। বছর চলে যায়, কাছে বসে গল্প হয়না।
– আপা।শুধু আমার বোন ছিল না, ছিল আমার অভিভাবক, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
– বোন বিয়ে হয়েছে রে মা, এটা মানতে হবে। এক কাজ কর, মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হও, আমি নাহিদ আর তুমি তিনজন মিলে পলি কে দেখে আসি। তাহলে, তোমার মন কিছুটা ভালো হবে।

কলি নিমিষেই দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।

আবিদের বাসা মানুষ গিজগিজ করছে। কলি৷ তাদের বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। আবিদ এসে কথা বলছে সবার সাথে।

কলি আস্তে করে বললো খালা, আপা কোথায়?
– একটু অপেক্ষা কর, নতুন বউ।

আবিদ বললো খালা চলেন ভিতরে, পলি ভিতরের রুমে আছে। নাহিদ চলো?
– আপনারা যান, আমি আসছি।

কলি এই কথা শুনেই, দাঁড়িয়ে আবিদের পিছন পিছনে যাওয়া শুরু করলো।

এল শেইপের বাড়ীটির একদম শেষের ঘর টা পলির। নতুন রুম এটাই, যেটা পলির জন্য তৈরী করা হয়েছে।

পলি খাটের এক কোনায় বিয়ের সাজেই বসে আছে। কলিকে দেখেই চমকে উঠে, জড়িয়ে ধরেছে। কলি আবারও শুরু করেছে কান্না।

রিতা খানম বললেন আর আরেক বার কান্না করবে, আমি চলে যাবো। এসেছো বোন কে দেখতে এসেছো, কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাবে, কান্নার জন্য নয়।

আবিদ বললো তোমরা দুই বোন গল্প কর, আমি বাইরে আছি।
– না, আপনি থাকেন দুলাভাই?
– না, আসছি।

কি রে, চোখ মুখ কান্নাকাটি করে, তো লাল করে ফেলেছিস।
– তুই তো আনন্দে আছিস আপা, নতুন সবকিছু। আমি তো জানি আমার কেমন লাগছে।
– আমি আমার সব মানুষ কে ছেড়ে নতুন জায়গায় এসেছি। তাছাড়া এরা সবাই কথা কম বলে, দেখা করে করে, যার যার রুমে চলে গিয়েছে।
– তাই?
– এই যে এতো মেহমান কিন্তু কেউ এই রুমে আসছেনা। যার যার গল্প করছে। আমাকে একটু দেখেই চলে যাচ্ছে।
– আবিদ?
– উনি রুমে আসছেন, যাচ্ছেন। নতুন জামাই লজ্জা পাচ্ছে।
– আস্তে আস্তে ঠিক হবে। প্রফেসর সাহেব মানুষ খুব ভালো।

কলি আস্তে করে বললো আপা, তুই বৌভাতের পরে কি এইখানের বাসায় যাবি, নাকি বাড়ী?
– কি করে বলি বল? এখনই এগুলো বলি কেমনে? আচ্ছা, কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?

– না রে আপা, মা চায়, তুই দুলাভাই নিয়ে বাড়ীতে যাবি।
– ভাবী কিচ্ছু বলেছে?
– আরে না।

ট্রে হাতে, আবিদের বোন রুমি এসে রুমে ঢুকলো। বললো আপনারা নাশতা খেয়ে নিন।

রিতা বেগম বললেন কেমন আছ তুমি?
– জি ভালো আছি।
– বসো।
– না, ঠিক আছে।
– কিসে পড়?
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্সে পড়ছি।
– তুমি কি আবিদের ইমিডিয়েট ছোট?
– না, আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই, আরিফ ভাই, মেডিকেলে ইন্টার্নশীপ করছে।
– আচ্ছা।
– আসি আন্টি, নাশতা করেন।

পলি দেখলো ট্রে তে এক প্লেটে মিষ্টি, তাতে দুটি চা চামচ দেওয়া। এক গ্লাস পানি, দুটি বাটি।

মানুষ তিন জন বাটি দুটি, পানির গ্লাস একটি, মিষ্টি কি কেউ চা চামচ দিয়ে খায়? পলি ভাবছে, এরা মেধাবী হয়েছে সত্য, কিন্তু রুচিশীল হয়নি, এমন কি মেহমানদারী ও ঠিক মতো জানে না। এর চেয়ে জলিপার বাড়ীর মানুষ এতো শিক্ষিত না হোক, কিন্তু শিষ্টাচার এদের চেয়ে ভালো জানে।

কলি বললো আপা, আমি মিষ্টি খাবো না। আমার মন একদম ভালো নেই, বিশ্বাস কর।

রিতা বললেন কি কলি, তুমি কি পলির মন খারাপ করতে এখানে এসেছো? তবে এক্ষুনি চলো।
– না খালা, আর আমি কিছুই বলছিনা।

পলি বললো খালা, মিষ্টি নেন।
– নিব, নতুন বউ এতো চিন্তা করেনা।

পলি শোন, শ্বশুর বাড়ী প্র‍থম এক বছর, হলো পরীক্ষা কেন্দ্র, সুতরাং পরীক্ষায় যেমন কোন প্রশ্ন কমন না পড়লেও আনসার করতে হয়। এখানেও তেমন ভালো না লাগলেও সব সুন্দর করে মেনে নিতে হয়, নিজের ভালো গুন গুলি তুলে ধরতে হয়। এক বছর তুমি সবার জন্য কর, সারাজীবন তারা তোমার জন্য করবে, ভালবেসেই দেখো একবার, উজাড় করে ভালবাসা পাবে।
– জি খালা, অবশ্যই চেষ্টা করবো।
– আজ আসি। আর ভালো থাকবে, কাল দেখা হবে।

পলিকে অবাক করে দিয়ে, আবিদ কি সুন্দর একটা পাথর বসানো স্বর্ণের আংটি গিফট করলো, সাথে এক জোড়া গোলাপ।

পলি মনে মনে খুব খুশি হয়েছে, হায়, এই চুপচাপ মানুষের ভিতরে এতো রোমান্টিকতায় ভরপুর!
বোঝাই দায়!

বৌভাতের দিন, সুন্দর করে শামিয়ানা টানানো হয়েছে। পলি কে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, তার মামী শ্বাশুড়ি। খুব স্নিগ্ধ লাগছিল পলিকে। আবিদ বার বার এসে বৌকে দেখা যাচ্ছিলো। আবিদ কে দেখলেই হাসি লাগছে পলির, লুকিয়ে দেখতে এসে বার বার ধরা পড়ছে সে।

রাহেলা খানম তার পরিবার, তার ভাইয়ের বউ, সাঈদের শ্বশুর বাড়ীর লোক, তার কিছু কলিগ, আর রিতা খালার পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে গেলেন। এদিকে তার মাথায় ঘুরছে তারা কি আজ বাড়ী যাবে নাকি?বাসায় যাবেয?

সব চিন্তা দূর হয়ে গেল পলির হাসি মাখা মুখ দেখে, আবিদ তাদের খুব যত্ন নিচ্ছে। প্রফেসর সাহেব বার বার সবার খোঁজ নিচ্ছেন।

কলি এসে বলছে আপা, আজ তোকে বিয়ের দিনের চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। দুলাভাই লোকটা ভালই মনে হচ্ছে।

শারমিন এসে পলির পাশে বসে বললো , আম্মা তোমাকে ফার্নিচার দিয়েছেন, বললে না তো!
– আম্মা দেন নি ভাবী, আমার শ্বশুর বানিয়েছেন।
– তাই?.
– হ্যা,, এবং এই রুম সাথে এটাচ বাথরুম বানিয়েছেন নতুন করে।
– ভালো, ভালো।

শারমিন ঘুরে ঘুরে দেখছেন তাদের বাড়ী। এতো ঝকঝকে না হলেও বেশ ভালো তাদের বাড়ী।

খাওয়া দাওয়ার পরে, রাহেলা খানম বললেন, বেয়াই সাহেব, আমার মেয়ে-জামাই কবে আমার বাড়ী যাবে?
– দুই দিন গিয়ে থাকার মতো সময় ছেলের নাই, ছুটি কম।
– আমি তো আমার বাড়ীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
– আগানী মাসে ছটিতে এলে, বাড়ী যাবে। আমার মা, গ্রামে থাকেন। এখানে আসার মতো শক্তি নেই। নাতি বউ দেখবেন, আশা করেছেন। আমি পড়শু দিন যাবো, গ্রামে সব আত্নীয়রা আসবেন।আগামীকাল আপনাদের বাসায় যাবে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে আসবে। কথা দিলাম, আগামী মাসে আসলে দিন চারেক থেকে আসবে, বউমা আর আবিদ।

শারমিন সাথে সাথে বললেন আগামী মাসে কিন্তু অবশ্যই দিতে হবে।
– হ্যা। মা, অবশ্যই দিব।

রিতা বললেন, বেয়াই সাহেব, আমি কিন্তু উকিল মা, আমি আজ আমার মেয়েকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো।
– আজ সারাদিন কত প্রকার ঝুট ঝামেলা গিয়েছে, আজ রেস্ট নিবে। কাল…
– নতুন বর কনের সময়ই তো এখন ঘুরার। আপনার বেয়াই তো আমাকে নিয়ে বৌভাতের রাতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার উকিল মেয়ে আপনি নিয়ে যান।

শারমিন বললো খালা, কাল দুপুরে কিন্তু আমার ননদ বাসায় পাঠিয়ে দিও।
– দেখা যাক।

কিছু কিছু সময় অনেক কিছু না হলেই ভালো হয়। এই মুহুর্তে বাড়ী যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই, পলি গিয়ে থাকবে, শারমিনের ও পছন্দ নয়। যাক, আল্লাহ ভালো একটা ব্যবস্থা করেছেন।

যতই দিন যাচ্ছে, ততই রিতা বেগমের কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছেন, রাহেলা। পলি আজ যেতে না পারলে মন টা কত খারাপ হয়ে যেতো। কি সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল।

রাহেলা খানম মনে মনে জাহিদ কে খুঁজছেন, এখান থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই জাহিদ কে বাজারে পাঠাতে হবে, কালকের আয়োজনের জন্য। মেয়েকে দেখে, জামাই দেখে খুব আনন্দ লাগছে রাহেলার। কিন্তু এখন মন অন্য জায়গায় আছে, কি ভাবে সুন্দর করে করা যায় কালকের দিন টি, এই চিন্তা লাগছে তার….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
১৩.০১.২০২২

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}