রাহেলা বেগম রাতের বেলা ভাইকে ফোন করে বললেন, যেন পাত্র পক্ষ কয়েকদিন পরে আসে। এখন এই মুহুর্তে কলির বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। যখন সময় হবে তিনি জানাবেন। যদিও প্রচন্ড রাগ করেছেন ভাই, তবুও তিনি বুঝিয়ে বলে, চিন্তা মুক্ত হয়েছেন।

আবিদ টুকটাক জিনিস প্রতিদিন একটু একটু করে কিনে আনে, আসবাব পত্র কিছুই কিনেনি কারণ পলি এখানে কিছু দিনের অতিথি মাত্র! পলির এই ছোট্ট রুমের টোনা-টুনির সংসার খুবই আনন্দের ও সুখের লাগে।

জলি দুই দিন পর এই বাসায় জামাই রনিকে নিয়ে এলো। চার তলা উঠে যেন পুরোপুরি হাঁফিয়ে গিয়েছে সে। রাহেলা বেগম মেয়েকে চিনতে পারছেন না, সারা শরীরে পানি চলে এসেছে। মুখ টা ছোপ ছোপ দাগ ভরে গিয়েছে।

রাহেলা চিন্তা করছেন, কষ্ট হোক তবুও এই সময়ে সত্যি তার মাকে দরকার, খুব ভালো হয়েছে এখানে এনে, নাহয় তিনি নিজেই কষ্ট পেতেন সবচেয়ে বেশি। সামনে থেকে মেয়ের যত্ন নিবেন, তাই শান্তি।

জলি বললো মা, এই চার তলার উপরে উঠান সহ ঘর কেমনে পেলে?
– নাহিদ ঠিক করেছে।
– খুব সুন্দর হয়েছে। মা, ডাক্তার কালকে দেখাবো, তোমাদের জামাই কাল ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাবে।
– কাল কেন যাবে? পড়শু যাবে।
– না, কালকেই চলে যাবে, কষ্ট হবে মা তোমাদের একটু।
– মায়ের কাছে এসেছিস, আর কি বলিস এসব!

কলি রান্না করছে আর ভাবছে সেও কি এক সময় এই বাসায় অতিথি হয়ে যাবে, জলি আপার মতো? তার ও কি এরকম মায়ের কাছে থাকতে হলে, সবার কষ্ট হবে কিনা, খেয়াল করতে হবে? দুনিয়া খুবই অদ্ভুত, খুব!

জলি রাতের বেলা, কলির পাশে গিয়ে বসলো, এই কলি আমি কি খুব বিশ্রি হয়ে গিয়েছি?
– না, কে বলেছে?
– আয়নায় দেখি।
– না, ঠিক আছ।
– সত্যি?
– সত্যি।
– তোর দুলাভাই আমার খুব যত্ন করে এখন আমার।
– হ্যা, দুলাভাই খুব ভালো মানুষ।
– আমার ইদানীং খুব মৃত্যু ভয় ঢুকেছে৷ মনে হয় আজই বোধহয় তোর দুলাভাই কে শেষ দেখা দেখছি, যদি মরে যাই?
– কি যে বলো আপা!
– আচ্ছা, যাই তোর দুলাভাইয়ের সাথে একটু গল্প করে আসি, ওই দেখ, ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।
– যাও।

জলি হাঁটতে ও যেন পারছেনা, খুব কষ্ট হচ্ছে। পেট বেশি বড় হয়ে গিয়েছে। জামাই ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে, জলি আস্তে করে গিয়ে পিছনে দাঁড়ালো।

জলি তুমি বাইরে এসেছো কেন?
– ঢাকা শহরে জ্বীন নাই। সমস্যা নাই বের হলে।
– জ্বীনের জন্য বলিনি, তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। চলো রুমে যাই, আমি এমনি রখানে দাঁড়িয়েছি।
– না, এখানে বাতাস লাগছে, ঘরে প্রচন্ড গরম।
– আচ্ছা থাকো।
– এই বাসায় আরেকটা রুম থাকলে, আজ রাত তোমার বাহুতে ঘুমাতাম, যদি মরে যাই, তবে কি আর থাকবো?
– কি বলে পাগল মেয়ে। মরবে কেন? আমাদের বাবু নিয়ে আমরা আনন্দে থাকবো।
– খুব ভয় হয়।
– আমি আছি তো! এখানে আম্মা আছেন, সবাই আছেন।

রাহেলা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েকে জামাইয়ের সাথে গল্প করতে দেখে, খুব ভালো লাগছে। যাক মেয়েটা অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি স্বচ্ছল না হলেও মনের দিক থেকে, অনেক শান্তিতে আছে।

পরের দিন ডাক্তার দেখানোর পর, ডাক্তার বললো বেবি বড় হয়ে গিয়েছে। আর রেগুলার কিছু হাঁটাহাঁটি দরকার, সাথে কিছু খাবারের পরিবর্তন দরকার। বাবু হয়তো আর দেড় মাসের পরের তারিখ দিল ডাক্তার আর কোন সমস্যা নেই আপাতত।

বাসায় আসার সময়, রনি সব ধরনের ফল, সবজি, হরলিক্স, দুধ কিনে আনলো, আর শাশুড়ী কে বললো আম্মা, আমি এখন দুই হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছি। আবার আগামী মাসে ডেলিভারির সম্পূর্ণ খরচ নিয়ে আসবো। এর মধ্যে যদি কোন সমস্যা হয়, আমার চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বরে কল দিবেন। আর আমি দুই দিন পর পর ফোন দিয়ে খোঁজ নিব।
– আমরা আছি তো! চিন্তা করবেনা বাবা। তুমি সাবধানে যাও।

পলির যেন চোখের পলকেই এক মাস হয়ে গেল। এই বাসায়। আবিদ বললো আমি তোমাকে নিয়ে আগামী শুক্রবার বাড়ী যাবো।
– আমি আর যাবো না। প্লিজ আমাকে বাড়ীতে দিবেনা। আমি এই বাদায় থাকবো, কিন্তু তোমার সাথে।
– পলি পাগলামি কর কেন? এই বাসায় কি পরিবার নিয়ে থাকা যাবে, তাছাড়া বাড়ীওয়ালা এক মাসের জন্য তোমাকে নিয়ে থাকার জন্য রাজী হয়েছে, সব সময়ের জন্য রাজী হবেনা।
– আমি তাদের রাজী করাবো।
– পলি, বাড়ীতে মা-বাবা আছেন কত কষ্ট পাবেন জানো?
– তোমার বড় ভাই, ঠিকই বউ নিয়ে থাকেন, কেউ কিছু বলেনা। আমার ওই বাসায় ভালো লাগেনা।
– ভাইসাহেবের ভালো চাকরি, সেজন্য থাকে।
– আমি তো তোমাকে ভালো চাকরি ধরতে বলছিনা! এইখানে, এইভাবে থাকতে চাই। শুধু তোমার সাথে।
– মাস্টার্সের ক্লাস করবেনা?
– আমি শুধু পরীক্ষা দিব।
– তোমার মাথা খারাপ হয়ে আছে, বোকা মেয়ে। আমি স্কুলে যাচ্ছি, সারাদিন চিন্তা কর।
– আমার ডিসিশন একই থাকবে, শত চিন্তা করার পরেও।

সকালে রনির সাথে দুই মিনিট কথা বলে এসেছে জলি। পুরোপুরি সুস্থ আছে। আরও পনেরো দিন পর ডেলিভারীর তারিখ। জলি রোদের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে।

মা তরকারী কাটছেন, সে গল্প করছে মা, তোমার জামাই শুক্রবারে আসবে, টাকা নিয়ে।
– আরও পনেরো দিন বাকি আছে। চিন্তা নাই।
– আমার শ্বাশুড়ি কত কাঁথা বানিয়েছেন, তাই দিবেন সাথে।
– আমার ও দশ টা কাঁথা সেলাই শেষ।
– সকালে শাহিদ কোথায় গেল?
– জাহিদ যাওয়ার জন্য বলেছে, তাই ওর এখানে গিয়েছে। বেতন দিবে, আর লাইব্রেরির কি কাজ ও জানি আছে।
– কবে আসবে?
– তিন দিন থাকবে, বললো।
– ওহ।

এই দিন সন্ধ্যার দিকে জলির ব্যাথা উঠেছে হালকা করে। জলির মুখ অন্ধকার হয়ে আছে ব্যাথায়। রাহেলা বেগম বুঝতে পারছেন না, এটা কিসের ব্যাথা? কিন্তু সময় সময় ব্যাথা বাড়ছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে সাঈদ কে আসতে বললেন অফিস থেকে ফিরতে যেন, এখানে আসে একবার।

নাহিদ বার বার বলছে মা, আপাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে?
– সাঈদ আসুক। ওর জানাশোনা ভালো আছে।
আর ব্যাথা কিসের বুঝতে পারছিনা।
– আমি এক টিউশনির বেতন শনিবারে পাবো, এখন কি টাকা আনতে যাবো?
– না, এখন তুই থাক এখানে। সব চলে গেলে হবে নাকি?
– আচ্ছা।

কলি বোনের পায়ে হাতে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। তার ব্যাথায় মুখ টা কালো হয়ে আছে। শুধু অস্থির অস্থির করছে সে।

সাঈদ আসলো ঘন্টা খানেক পরে। এসে বললো আমি কি এসব বুঝি? আমাকে যে ডাকলে।
– হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাই চিন্তা করছি, কোথায় নিব? আমি কি ঢাকায় কিছু চিনি!
– কিরে জলি তোর জামাই কত দিয়ে গিয়েছে?
– জামাই শুক্রবার দিন আসার কথা। এখন হাজার দুই টাকা আছে, আমার হাতে ও টাকা নাই, জাহিদের বেতন আনতে গিয়েছে শাহিদ। মাসের শেষ, এখন!
– মা, দুই হাজার টাকায় ডেলিভারি হয়?
– জামাই এসে দিয়ে দিবে, তুi এক্টু নিয়ে যা বাবা।
– এই নাহিদ বেবি ডাক, ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যেতে হবে। সরকারি ছাড়া হবেনা।
– ঢাকা মেডিকেল অনেক দূরে।
– মা, তোমার যেমন টাকা, তেমন ব্যবস্থা। এই টাকায় আর কোথায় নিয়ে যাবে? আর টাকা সাথে নাও পরে গিয়ে বলবে, ভুলে গিয়েছিলে আনতে। এক্ষুনি নাও।

নাহিদ আর কথা না বাড়িয়ে বেবি টেক্সি ডাকতে বেড়িয়ে গেল, তার পকেটে একশো টাকার দুটি নোট এছাড়া কিছুই নেই। ভাইজানের কথা শুনলেই মাথা ধরে যায়।

কলি তিন বার রনির চাচাতো ভাইকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু কেউ ফোন ধরছেনা। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে।

জলি গাড়ীতে উঠার সময় বারবার বলছে কলিরে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, যেমনেই হোক, তোর দুলাভাইকে ফোনে খবর দে।

কলির বোনের কষ্ট দেখে, দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, আহারে! একটা সন্তানের জন্য কত কষ্ট করছে জলিপা।

রাহেলা বেগম মেয়েকে শক্ত করে ধরে আছেন, জলির ব্যাথা বাড়ছে, আর বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে। তিনি বারবার চিন্তা করছেন, কেন তিনি এমন পাষান ছেলেকে পেটে রাখলেন, যে বোনকে ডাক্তার নিয়ে যাওয়ার আগে, টাকা কত আছে সে হিসাব নেয়। আজ আর কোন উপায় নাই, সাঈদ ছাড়া। তাই তিনি এই রাতের বেলা তাকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, হাত একেবারেই শূন্য বলে, নয়তো তিনি বলতেন না। শাহিদ থাকলে, একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতো! কিন্তু সেও নেই এখন।

নাহিদ সামনে বসেছে, বার বার ঘুরে বোন কে দেখছে। চেহারা কেমন কালো হয়ে আছে জলির।

রাহেলা বেগম বার বার আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, আল্লাহ আমার মেয়েকে উদ্ধার কর, সুস্থ বাবু দাও। কোন ধরনের অপারেশন যেন না লাগে। সব কিছু সুন্দর কর সহজ কর মাবুদ….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
১০.০২.২০২২

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}