পলি এই শহরে কিছুই চিনেনা। একা একা কোথায় গিয়ে কল দিবে! তাই বাড়ীওয়ালা খালার কাছে গেল। তিনি বসে বসে উলের সুতা দিকে যেন কি বুনছিলেন।

খালা আসতে পারি?
– হ্যা। এসো।
– আমি একটা ফোন দিতে চেয়েছিলাম, আমার শ্বাশুড়ির কাছে। কাছাকাছি ফোনের দোকান কোথায় আছে খালা?
– তোমার একদম কাছাকাছি আছে।
– কোথায়?
– আমার বেড রুমে, আমার বাসায় ল্যান্ড ফোন আছে। ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ কল দে।
– আমি বাইরে কোথাও থেকে করে নিব।
– আরে, মেয়ে যাও, করে নাও। কোন সমস্যা নেই।

পলির আর এতো কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। তাই সে, ফোনে নাম্বার ডায়াল করলো। রিং বেজে যাচ্ছে, এখনো কেউ ধরছেনা।

দ্বিতীয় বার চেষ্টার পরে ফোন ধরলেন প্রফেসর সাহেব।

আসসালামু আলাইকুম আব্বা, আমি পলি।
– ওয়াকাইকুম আসসালাম।
– কেমন আছেন?
– ভালো আছি। এখন কলেজে যাবো।
– আম্মা কোথায়?
– ভালো আছে সে। আর কিছু বলবে?
– আম্মা কি রান্নাঘরে?
– হ্যা। কথা বলবে?
– জি আব্বা।
– দুই মিনিট পরে কল দাও। আমি ডেকে দিচ্ছি।
– জি।

দুই মিনিট পরে পলি আরও পাঁচ বার চেষ্টা করলো, কিন্তু আর লাইন পাওয়া গেলনা। বার বার ই লাইন কেটে যাচ্ছে। পলি আগেই জানতো, এই ল্যান্ড ফোন বিশেষ সুবিধার নয়, প্রায়ই নষ্ট থাকে।

পলি বসার ঘরে গিয়ে বললো, খালা এক মিনিট কথা বলে, আবার কল দিলাম, আর যাচ্ছেনা।
– একটু পরে, আবার দিও।
– জি আচ্ছা। আসি খালা।
– বসো। মন খারাপ নাকি? কেমন চুপ করে আছ?
– না না।
– থাকবা আর কয়েকদিন?
– জানিনা খালা, ও চলে যেতে বলছে। হয়তো কাল/পড়শু চলে যাবো।
– এই ব্যাপার! মন টা খারাপ?
– না, মন খারাপ না।
– শোনো, বিয়ের প্রথম তিন/চার বছর এই ধরনের খারাপ লাগা, খুব বেশি পরিমাণে থাকে, বেবি হয়ে গেলে দেখবে খারাপ লাগা আস্তে আস্তে কমে যাবে। আর তুমি যাবে কেন? এখানেই থাকো। এই সময় গুলি আর ফিরে আসেনা।
– দেখি খালা!
– আমাদের মানুষ জন সব উলটা পাল্টা কাজ করে। নতুন বউকে ছেলের সাথে না দিয়ে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বিয়ের পর পর ছেলে বউ একসাথে থাকবে, সম্পর্ক মজবুত হবে, এটাই সুন্দর। এটা তারা চায়না। তুমি এখানেই থেকো।
– জি খালা দেখি!

পলি আর কিছুই বলেনি, থাক কি হবে আর বলে! নিজের সংসারের কথা বাইরে না গেলেই ভালো। আর সে যখন চায়না, আর এখানে থাকবেনা। সেই দম বন্ধ করা যায়গায় আবার যেতে হবে।

রাহেলা বেগম রোদের মধ্যে নাতিকে ভালো করে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন। সে বড় বড় চোখ করে নানীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাহেলা বেগম বাবুর সাথে কত কিছু গল্প করছেন, সে যেন সব বুঝতে পারছে। আজ শুক্রবার, সব ছেলেরা বাসায়। জলির জামাই, রনি ও আছে, সে আজ বিকেলে বাড়ি যাবে। গত রাত সে তার মামার বাসায় গিয়েছিল, আজ সকালে এসেছে। ছেলেকে দেখে বাড়ী যাবে।

সাঈদ একটা ব্যাগে করে কিছু সবজি নিয়ে এসেছে। ব্যাগ টি রান্না ঘরে নিয়ে রেখে, মায়ের পাশে এসে বসলো।

মা কেমন আছ?
– ভালো আছি বাবা।
– আমার ছেলেকে এভাবে আদর করে দিলেনা, কোন দিন!
– সুযোগ পাইনি বাবা, না হয় দিতাম।
– এখন আরেকটা সুযোগ আসছে মা! তুমি আবার দাদী হবে।
– আলহামদুলিল্লাহ! খুব খুশির সংবাদ।
– কাল টেস্টের রিপোর্ট আসছে।
– জিহান ভাই কি করছে?
– সারাঘর মাথায় করে রাখছে, আর তোমার বউমা তার পিছনে পিছনে দৌড় দিচ্ছে।
– মেয়েটার যত্ন নিস।

রনি এসে সালাম দিয়ে বসে তার মামাতো ভাইয়ের প্রস্তাব আবার সাঈদ কে বলছে এখন।

রাহেলা বেগম আড় চোখে জামাইকে দেখছেন বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে।

সাঈদ সাথে সাথে বললো না,না। এতো অল্প শিক্ষিত ছেলের কাছে কলিকে বিয়ে দিব না। ও এম.এ পাশ করুক দেখি কি করা যায়!
– ভাইজান, আপনি একবার আমার মামার বাড়ীখানা দেখে আসবেন, চলেন। না করতে পারবেন না।
– রনি, থাক। ওর বিয়ে এখন না, কিছুদিন পরেই দিব।

নাহিদ রুমে বসে সব কথা শুনে বেশ অবাক হচ্ছেন, ভাইজান তো এরকম না করার মানুষ না। বোনেদের বিদায় দিলেই তিনি শান্তি! আর ধনী ছেলে হলে, তো আর কথা নেই। নিশ্চয়ই এর ভিতরে কি একটা ঝামেলা আছে। কিছুক্ষণ পরে হয়তো ধরা যাবে

সাঈদ বললেন মা, আজ দুপুরে আর রাতে আমার বাসায় খাবে, জলির জামাই সহ দাওয়াত।
– দুপুরের রান্না শেষ। আর জলি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আরেকবার জামাই আসলে, নিয়ে যাবো।
– না না। আমি সব বাজার করে দিয়ে এসেছি। জলির খাবার পাঠিয়ে দিব, সবাই দুপুরে আমার বাসায় খাবে।
– আমি আর জলি যাবো না। আর রাতে না, শুধু দুপুরেই খাবে।
– না, তোমাকে যেতেই হবে। শাহিদ-নাহিদ খেয়ে চলে আসবে, জলির পাশে বসবে এসে।
– আচ্ছা দেখি বাবা।
– আর দেখা-দেখি নাই। আমি যাচ্ছি।

কলি আস্তে করে নাহিদ কে বললো কিরে তুই অংক মিলাতে পারছিস?
– তুই পেরেছিস?
– আমি তো অংকে কাঁচা।
– আমি দাওয়াতে নাই, আমি বাসায় ডাল-ভাত খাবো। তোরা যা!
– আমার ও ইচ্ছে নেই। কি উদ্দেশ্য আছে কে জানে।

পলি গতকাল রাতে শ্বশুর বাড়ী এসে পৌছেছে। মন খুব একটা ভালো নেই, থাক তার যখন ইচ্ছে নেই জোড় করে তো আর থাকা যায়না!

পলি গিয়ে রান্নাঘরে দেখছে, শ্বাশুড়ি তার সেই আলু ভর্তা মাখিয়ে নিচ্ছেন।

পলি সেদিন অনেকক্ষণ ফোনের পাশে বসেছিলাম। আর ফোন দিলেনা?
– লাইন পাইনি আম্মা।
– ওহ। আচ্ছা শোন, আরেকটা খবর তোমার ডাক্তার দেবর, এখনো ইন্টার্ণশিপে রয়েছে, কিন্তু মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে। এই মেয়েকে ছাড়া নাকি সে বাঁচবেনা। কত যন্ত্রনা!
– ওহ!
– এখন, তোমার শ্বশুর বলেছিলেন, ছোট খাটো অনুষ্ঠান করে বউ তুলে আনবে। বউ এম.বি.এ পাশ করেছে, ওর সম বয়েসী। বউ তুলে ওদের কি একটা বাসা ভাড়া করে দিয়ে আসবেন। তারা টুনাটুনি থাকুক।
– এটাই ভালো। তাদের মতো করে, সংসার ঘুছিয়ে নিক।
– ভালো হয়েছে। আম্মা কিছু সাহায্য করি?
– না, কিছুই লাগবেনা। তুমি আবিদের কাছে যাও, দেখো কিছু লাগে কিনা!

পলি রুমে এসেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এই জীবনে জোড় যার মুল্লুক তার। তার দেবর এখনো চাকরি করেনা, তবুও বউ নিয়ে তার মতো করে বাসায় থাকবে। বড় ভাসুর ও থাকছেন। শুধু সেই থাকতে পারবেনা। কারণ আবিদ কিছুই বলতে চায়না, সে চুপচাপ থাকে, তার স্বল্প আয় সেজন্য হয়তো। পলি, চিন্তা করলো, এই পৃথিবীতে কেউ মনের কষ্টের খবর রাখেনা। এইখানে সবাই যার যার ব্যস্ত, অচেনা জায়গা এতো খারাপ লাগে তবুও থাকতে হবে! কারণ তার যে তীব্র কষ্ট আছে, দেখা যায়না। সুতরাং তার কোন কষ্ট নেই, এটাই প্রমানিত।

রাহেলা বেগম আর নাহিদ ছাড়া সবাই দাওয়াতে যাচ্ছে। রাহেলা বেগম নাতি আর মেয়ের কাছে থেকেছেন। রাহেলা বেগম অনেক জোড় করেও নাহিদ কে পাঠাতে পারেন নি। তার এক কথা আমার ঘি ভাত হজম হয়না মা, আমাকে ছেড়ে দাও।

কলি ঘরে ঢুকতেই দেখলো পোলেয়ার গন্ধে সারা বাড়ী মৌ মৌ করছে। ঘরে আরও অতিথি আছেন, সাহেদা বেগম এসেছেন সাথে আইরিন আর তারিন।

সাহেদা বেগম দেখেই বলছেন, কি গো কেমন আছ? আমার জামাই তো তোমাদের বাসায় নিয়ে গেল না।
– আজ চলে আসেন খালাম্মা।
– আজ বিকেলে আমি বাসায় চলে যাবো।

শারমিন কলিকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে সব রান্না দেখিয়ে বলছেন, দেখো সব ঠিক আছে?
– জি ভাবী।
– একটু টেস্ট করে দেখো।
– ঘ্রান ভালো আসছে, মজা হয়েছে।
– আরে, নাও দেখো।

কলির মাথায় কিছুই ঢুকছেনা হঠাৎ করে ভাবীর এই ব্যবহার তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে! এরকম খাতিরের পিছনে কি কোন কাহিনী কি আছে! নাকি ভাবী সত্যি ভালো হয়ে গিয়েছেন, কিছুই বুঝতে পারছেনা কলি…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
১৯.০২.২০২২

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}