আজ এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ছেলে পক্ষ থেকে কোন খবর আসেনি, রাহেলা বেগম প্রতিদিন রুমির ফোনের অপেক্ষায় থাকেন, হয়তো ভালো কোন খবর আসবে।
কলি বার বার বলছে মা, বাদ দাও তো! শুধু শুধু অপেক্ষা কর না, অসহ্য লাগে। আমি আর নাহিদ কলি আপার বাসায় বেড়িয়ে আসি।
নাহিদ বললো আমি তোকে দিয়ে আসবো কিন্তু থাকতে পারবো না, কারণ স্টুডেন্টদের পরীক্ষা পরে, আবার নানান ধরনের ঝামেলা হবে।
– খালার বাসায় যাবি?
– না, আমার ভালো লাগেনা।
– ওখানে লুবাবা আছে চল।
– তুই যা। আমি যাবো না। চট্টগ্রাম গেলে চল, কাল শুক্রবার আছে, টিকেট কাটি।
ওমা! আমি যাই?
– মেয়েদের এতো অস্থিরতা ভালো নয়। আর ওদের টুনাটুনির সংসার, তুই গিয়ে কি করবি?
– মা, আমাদের কি শখ নেই, কোথাও যেতে গেলেই অযুহাত। নানুর বাড়ী পর্যন্ত যেতে পারিনা।
– যা, আমার কাছে টাকা নাই।
– ছিল কবে?
এই কলিপা আমি নিয়ে যাবো, কয় দিন থাকবি, ব্যাগ গুছিয়ে নে। ট্রেনের শোভন চেয়ার কিন্তু।
– হবে, হবে। এক্ষুনি তোকে ঠান্ডা শরবত দিচ্ছি।
– আমি ঘুষ নেই না! যা, ব্যাগ গুছিয়ে নে।
রাহেলা বেগমের এক চিন্তা কলি, মেয়েদের বিয়ে হলেই চিন্তার ইতি। ছেলেরা তাদের মতো করে, পছন্দ করে, বিয়ে করে নিবে। কিন্তু মেয়েদের কে, সুপাত্রের কাছে দিতে না পারলে অশান্তির শেষ নেই।
সাঈদ জিহান কে নিয়ে রাতের বেলা এসেছে, হাতে দুই হালি ডিম। ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসেছে সাঈদ।
কলির বড় ব্যাগ দেখে বললেন কি রে কোথায় যাস?
– পলিপার বাসায়!
– পলিপার বাসায় যেতে পারিস আর ভাইয়ের বাসায় যেতে পারিস না! এখন তো ভাই ছাড়া থাকার জায়গা হয়েছে কিনা!
কলি চুপ করে শুনছে সব কথা, কোন উত্তর দিচ্ছেনা।
সাঈদ, রাহেলা বেগম কে বললো, পলি আমার বাসায় থাকলো, বিয়ে পর্যন্ত দিয়ে দিলাম। অথচ একটা দিন ফোন দিয়ে বললো না, ভাইজান চট্টগ্রাম আসেন, বেড়িয়ে যান!
– ফোন নাই বাবা ওর।
– বলার মন নাই, সেটা বল। জাহান আমাকে এজন্য খোঁটা দে, যে এরা কেউ কখনো তোমাকে ভালবেসে কিছু করেনা।
– তুমি গেলে কত্ত খুশি হবে, যাও ঘুরে এসো।
— আমি কি নাহিদের মতো চাইলেই যেতে পারি? কত টাকা পয়সার ব্যাপার। জাহানের কত্ত দিনের শখ কক্সবাজার যাবে, তাই যেতে পারিনি!
– এখন ঘুরে এসো।
– না! আমি যাই, আর কলি বড় হয়েছে, যেখানে-সেখানে থাকতে দিওনা, এমনি ভালো প্রপুজাল আসেনা। বয়স তো শুধু বাড়ছে!
কলি সাথে সাথে গাল ফুলিয়ে বলছে মা, আমি কি খুব বোঝা হয়ে গিয়েছি? আমি কি কোন খারাপ কাজ করছি? নাকি অন্যায় করছি? কেন আমাকে ভাইজান এসব কথা বলেন।
– রসুনের চামড়া গায়ে কেন? ভাই কিছু বললে এমন করে উঠিস কেন? তোর আব্বা থাকলে জীবনেও তোকে এভাবে যেতে দিত না! যাই হউক এখন নিয়ত করেছিস, যা ঘুরে আয়। আর, মেয়েদের চামড়া গন্ডারের মতো মোটা হতে হয়, মনে রাখিস।
কলির আজ খুব আনন্দ হচ্ছে, যাক এই প্রথম বেড়ানোর জন্য কোথাও যাওয়া হচ্ছে। নাহিদ ট্রেনে ঘুরাঘুরি করছে, শান্তি নেই। এরকম একা একা ভয় লাগে, ট্রেনে। অথচ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ঘন্টা খানেক হবে, তার খোঁজ নেই। রাতের ট্রেনের সব মানুষকেই যেন ডাকাত লাগে!
হাতে একটি প্লেট নিয়ে নাহিদ ফিরে এলো।
– কি রে তুই? একা রেখে হাওয়া হয়ে গিয়েছিস?
– খা! নাশতা রেডি হতে দেরী হয়েছে।
– মাত্র ভাত খেয়ে আসলাম।
– ভাইরে, পরে খাবি রাখ!
কলি আস্তে করে টিস্যু উঠিয়ে দেখলো, একটা স্যান্ডুইচ, একটা কাটলেট আর একটা চিকেন ফ্রাই।
কি রে নাহিদ এতো কিছু কিনেছিস কেন?
– প্রথমবার চট্টগ্রাম যাচ্ছিস, ভালো করে খেয়ে দেয়ে যা!
– টাকা নষ্ট করলি কেন?
– এই হচ্ছে মেয়েদের এক সমস্যা! যদি কিছু কিনে না দাও কিপটা আর দিলে, টাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
– প্রেম করছিস? অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
নাহিদ লজ্জা পেয়ে বলছে, তুই একটু বেশি বুঝিস!
– রাতে কার সাথে গুন গুন করি।
– কারো সাথে না, তবে একজন আমার কানে গুনগুন করে।
– কে?
– মশা। এখন তুই নাশতা খা!
কলি দেখছে, তার ছোট্ট ভাইটা কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে। এই সামান্য নাশতাই যে তার কাছে কত্ত দামী! এত যত্ন করে এনেছে, তাই অনেক ভালো লাগছে। জলিপা নিশ্চয়ই সুন্দর করে নিজের মতো করে সব গুছিয়ে সংসার করছে! কত জায়গায় ঘুরবে, সব কিছুর লিস্ট মনে মনে ঠিক করছে কলি!
ভোর সাতটায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই আবিদ বেড়িয়ে এলো! আহা! শালিকা অপেক্ষা করছি তো!
– আপাকে বলেন নি তো আবার?
– না, না। তোমার আপা রান্নাঘরে যাও। শালাবাবু বসো।
কলি পিছন থেকে বোন কে জড়িয়ে ধরতে বেশ অবাক হয়েছে পলি। আরে! কলি? তুই? কিভাবে!
হাতে খুন্তি ছিল পলির, তরকারি রান্না করছিল সে, বরের টিফিন দিবে। বোন কে দেখে, হাত না ধুয়েই জড়িয়ে ধরেছে।
কলি সকালের নাশতা করে, বোনের সাথে কুটকুট করে গল্প করছে। নাহিদ দুলাভাইয়ের সাথে বেড়িয়ে গিয়েছে, সে নাকি একা একা ঘুরবে।
পলি বলছে তুই তোর দুলাভাইকে, আমাকে বলতে নিষেধ করেছিস?
– হ্যা, কাল দুলাভাইয়ের স্কুলে ফোন দিয়ে, ঠিকানা নিয়ে বললাম তোকে এসে সারপ্রাইজে দিব।
– এজন্য কি নাশতা করলি, আগে জানলে রান্না করে রাখতাম!
– তোর সাথে গল্প করছি কত্ত দিন পর! নাশতা লাগবেনা আর! এতো ছোট্ট ঘর নিয়েছিস কেন আপা?
– বড় ঘর দিয়ে কি করবো? দুজন মানুষ। আর ওর যা ইনকাম তাতে এই ঘর আসবাবপত্র দিয়ে সাজাতে অনেক সময় লাগবে!
– তুই কোন ফার্ণিচার আনিস নি?
– না,আর এগুলো শ্বশুরের জিনিস৷ আমি এনে কি করবো!
– মা তোকে এক সেট ফার্নিচার দিলেই ভালো হতো! একই টাকার গহনা তো দিলেন।
– হবে, আস্তে আস্তে।
– তোকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
– থাপ্পড় দিব নাকি? বেশি কথা বলিস কেন!
দুই দিন থাকার পর, কলি বুঝলো আপার সংসার খুব টেনেটুনেই চলছে। এই শহরে দুই জন মানুষের থাকাই অনেক কষ্ট, তাদের জন্য । আবিদের সামান্য বেতন আর দুই/তিন টি টিউশনি। তাতে চলছে একমতো! বয়স্ক মানুষের অভিজ্ঞতা বেশি, মা না করেছিলেন শোনা উচিত ছিল, হয়তো আপার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নাহিদ ও রাতের ট্রেনে চলে গেল, নয়তো পরের দিন ফিরতো সে।
জাহিদ আজ ঢাকায় এসেছেন। হাত ভর্তি বাজার।
রাহেলা বেগম বলছেন, কি রে এতো বাজার নিয়ে এসেছিস কেন?
– খাবো। এজন্য।
– কলি কবে গেল?
– সপ্তাহ খানেক হয়েছে।
– আমাকে বললে নাতো!
– আসবি জানি, এজন্য বলা হয়নি। মন ও ভালো নেই। এতো ভালো স্বমন্ধ আমার একটু ভুলের জন্য হয়তো হয়নি।
– আফসোস কর কেন? যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। চিন্তা কর না।
কলির এই বাসায় দমবন্ধ লাগে। এতো চটপটে পলিপা সারাদিম এই ঘরে একা একা কেমনে থাকে! এই এক সপ্তাহে দুলাভাই একদিন আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যায়নি। সে তার গতিতে স্কুল – টিউশনি করে ঘরে ফিরছে। কলির একদম আর ভালো লাগছেনা! কেন যে এখানে এলো, কে জানে!
সন্ধ্যায় রুমি ফোন দিয়েছেন, রাহেলা বেগম কে বলছেন, আপা আগামী শুক্রবারে কলিকে নিয়ে রেডি থাকবা আমি আসছি, এবার ঘরে থেকো।
– আলহামদুলিল্লাহ! উনারা রাজী হয়েছেন?
– তুমি দোয়া কর আপা, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে হবে। এখন রাখি, একটু বের হবো।
– আচ্ছা।
রাহেলা বেগমের এতো শান্তি লাগছে খবর শুনে! আল্লাহ মেয়েটাকে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দাও। ঘরে দৌড়ে এসে, রাহেলা বলছেন বাবা জাহিদ তুমি ভালো সময় এসেছো। আজ রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাও, কলিকে নিয়ে এসো। জামাইপক্ষ শুক্রবার আসছে, রুমি ফোন দিয়েছে।
– বাহ, সুসংবাদ। আজই যাবো? এখনো শুক্রবার দেরী আছে।
-আমি আর দ্বিতীয় বার ভুল করতে চাইনা। তুমি তাড়াতাড়ি মেয়ে ঘরে নিয়ে এসো।
–আচ্ছা।
আল্লাহ আমার আজ কি শান্তি লাগছে, আমি এক্ষুনি শোকরানা নামায আদায় করে আসি, আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে চিরসুখী করেন…
চলবে…