সকাল থেকে পলি, তার জামার বড় দাগ টা কোন ভাবেই তুলতে পারছেনা। এটা পরেই আজ জলির বাড়ী দাওয়াতে যাবে সে, এজন্য দাগ তোলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এই জামা সাঈদের শ্বশুরবাড়ী থেকে উপহার পেয়েছিল পলি। সাদা জামা, কিন্তু ওড়না টা সুতার কাজ করা। খুব যে দামী তা নয়, কিন্তু পরলে বেশ ভালো লাগে, সুতির হলেও মন্দ নয়।

পলি আবার ও মায়ের কাছে গিয়ে বললো, মা, লেবু দিয়ে অনেক্ক্ষণ জায়গা টায় ঘষাঘষি করলাম, কিন্তু হলুদের দাগ উঠছেনা।
– অন্য জামা পরে যাবি, এটা বাদ দে।
– আমার আর কোন ভালো জামা নেই।
– পলি, আমার এমনি মনটা ভালো লাগছেনা। তুই যা ইচ্ছে কর! এখান থেকে যা।

জলির বাড়ী যাওয়ার জন্য সাঈদ ছাড়া সবাই রেডি হচ্ছে, সাঈদ বিয়ের দিন ই চলে গিয়েছে। তাদের সাথে আরও যাচ্ছেন, রাহেলা খানমের মেজ ভাই, আর ভাসুর। এই নয়জন মানুষ জলির বাড়ী দাওয়াতে যাচ্ছেন।

রাহেলা খানম সকাল পর্যন্ত না করছিলেন, তিনি যাবেন না। জাহিদ বললো মা, তুমি জলিপা কে দেখলে শান্তি পাবে, তাছাড়া আরেকদিন যেতে হলে খরচ যোগাড় হবেনা, যাওয়া হবেনা। পরে, অনেক কথার পর রাহেলা খানম যেতে রাজী হলেন।

রাস্তার পাশেই জলির বাড়ী, টিনের বেড়া দেওয়া দুই রুমের ছোট্ট বাড়ী, এক রুমে শ্বাশুড়ি আর দেবর ননদেরা থাকে, অন্য রুম জলির।

রুমের মধ্যে একটা খাট আছে, একটা আলমারী, একটা চেয়ার, আর মুখ দেখার জন্য একটা আয়না।

রাহেলা খানম দেখলেন জলি খাটের উপর বসে আছে সবাইকে দেখে দৌড়ে নেমে সালাম করলো। তারেক ও তিন জন মুরুব্বিকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।

রাহেলা খানমের মেয়ের বাড়ী দেখে মনটা কেমন খচখচ করছে। এতো ছোট্ট ঘর। তেমন কোন আসবাব পত্র ও নাই। এরচেয়ে তাদের অবস্থা অনেক উন্নত।

জলির শ্বাশুড়ি খুব আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন, আর বলছেন বেয়ান আমার খুপরি ঘর, কি করবো বলেন, আমার তারেকের ভালো চাকরী হলে ঘর দিব,আশা করে। আমার সাহেব অল্প বয়েসে মারা গিয়েছেন তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে বিরাট বিপদে ছিলাম। আল্লাহ অনেক খানি উদ্ধার করেছেন।

কলিকে তার মেজ মামা হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলেন,

কিরে, জলির এমন ফকিন্নি জায়গায় বিয়ে কে ঠিক করলো?
– ভাইজানের কাছে আলাপ আসছিল।
– হায়রে! ছেলের শিক্ষা কম, সহায় সম্পত্তি নাই। ঘরে আর ভাই-বোন আছে। কেমনে যে কি করে সাঈদ বুঝিনা। তবে, এরা আন্তরিক আছে, জলির যদি আদর করে তাই শান্তি। আর তো কিচ্ছু করার নাই,এখন।
– জি মামা।

কলির ও মন টা খারাপ হচ্ছে মামার কথায়, কিন্তু তারেক দুলাভাই খুব মজার মানুষ, তিনি বেশ রসিকতা করছেন, মিষ্টি পানের ব্যবস্থা করেছেন দুই শালীর জন্য। জলিকেও বেশ পছন্দ হয়েছে, বুঝা যায়!

জলি আসার সময় পলিকে কানে কানে বললো,
মাকে বলবি চিন্তা না করতে, উনি মানুষ ভালো, আম্মা, মানে আমার শ্বাশুড়ি ও খুব ভালো। তোর দুলাভাই খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। আমার দুঃখ নাই গরীব ঘরে বিয়ে হওয়ায়, উনি মহব্বত করলেই আমি খুশি।

পলি হাসছে, তার এই বোন সব সময় অল্পতেই খুশি হয়। সে যে ভালো আছে তাই ভালো। মাকে বললে হয়তো তিনিও শান্তি পাবেন।

এক মাস পরে, সাঈদের চিঠি বাড়ী আসলো, এই চিঠির জন্য তিন ভাই-বোন অপেক্ষা করছে…

রাহেলা খানম কলিকে চিঠি পড়তে বললেন,

শ্রদ্ধেয় মা,
আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। তোমার বউমার শরীর বেশি ভালো না, বাবা মারা যাওয়ার পর, আরও দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছি। এখন এক বেডের বাসা নিয়েছি, আমার শ্বশুরের বাসার কাছে, যাতে সে সারাদিন মায়ের বাসায় থাকতে পারে। মা, নাহিদ কে আগামী দু/এক দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিও, ওর এইচ.এস.সির পরীক্ষার রুটিন হয়েছে। সে চলে আসুক, এখানে এসে পরীক্ষা দিবে। আর পলি আর কলিকে আরও মাস দুয়েক পরে, কলেজের হলে তুলে দিব, এখন আমার পক্ষে তিন জন কে বাসায় এনে রাখা সম্ভব না। নাহিদ কে পাঠিয়ে দিও আর সাথে দশ কেজী দুধ দিও, জাহানের খাঁটি দুধ খাওয়া দরকার।
দোয়া রাখবে, নতুন স্যার সুবিধার নয়, যেকোনো দিন ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারি।
ইতি,
সাঈদ।

কলির মুখটা একদম মলিন হয়ে গেল, তাদের যাওয়া টা অনিশ্চিত হয়ে গেল। নাহিদ একা একা কেমনে গিয়ে থাকবে? পরীক্ষা কিভাবে দিবে?আলু সিদ্ধ খেয়েই পরীক্ষা দিতে হবে।

রাহেলা খানম বললেন, কি করবে সে? ঝামেলায় আছে এজন্য নিতে পারছেনা, বই খাতা আছে এখানে বসেই পড়। পরীক্ষা দেরী আছে।
– মা, তুমি সব জানো না। এজন্য কথা এভাবে বলছো! আমি আমাদের চিন্তা করছি না, নাহিদের চিন্তা করছি।
– নাহিদ ছেলে মানুষ তার একা থাকতে সমস্যা কি?
– সমস্যা কি শুনবে?
– কি সমস্যা শুনি…
– আমাদের জন্য মাছের লেজ, লেজের সাইডের টুকরা থাকে, নাহিদ কাটা সহ মাছ খেতে পারেনা। আপা, ভাবীকে বলতো আমরা মাছ পছন্দ করিনা, তুমি দুই পিস রেখে দাও মাঝের এক পিস দাও ভাবী। ভাবী বিরক্ত হয়েই দিতেন।
– মানুষ বেশী তাই…
– না, সেজন্য না। ভাবী আমাদের থাকা পছন্দ করেন না, নাহিদ ডালের উপরেএ পানি একদিন খেয়েছিল দেখে ভাবী সব ডাল ফেলে দিয়েছেন, বলেছেন এই ডাল আর খাবে না। আপা আর আমি ওকে আগলে রাখি।
– ও বড় হচ্ছে কলি, দুই দিন পরে ভার্সিটিতে যাবে, তখন একাই থাকবে, ওর নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হবে।
– তুমি কখনোই কারো দোষ দেখো না!
– যা, নাহিদ কে গিয়ে খবর দেয়, ব্যাগ গুছিয়ে পাঠাতে হবে।
– কথা ঘুরিয়ে দিলে না?
– যেটা বলেছি কর।

কলি চলে যাওয়ার পর, রাহেলা খানমের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এসব কথা শুনলে বুক টা ছিড়ে যায়। কিন্তু তিনি অপারগ ছেলে-মেয়েদের সামনে তিনিও কথায় তাল মেলালে, তারা আর কষ্ট পাবে, তারা যেন ভেতর থেকে শক্ত হয়, তাই তিনি এমন ভাব ধরে থাকেন। সন্তান কষ্টে থাকলে, মায়ের মনের ভেতর কতটুকু কাঁদে সেটা কে বুঝবে!

রাহেলা খানম ভাবছেন প্রথম তিন সন্তান মারা যাওয়ায় তিনি ভয়ে এতো গুলি সন্তামের জন্ম দিয়েছেন, ভেবেছেন প্রথম তিন জনের মতো বাকীরাও যদি মারা যায় অল্প বয়েসে।

নয়তো এই ভুল তিনি করতেন না। কবে, যে ছেলে মেয়েরা দিক লাগবে, সে চিন্তায় অস্থির লাগে রাহেলার! কলি-পলির পড়াশোনা আর হবে তো! এটাই এখন বেশি ভাবাচ্ছে রাহেলাকে!

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
২৬.১১.২০২১

About

Annama Chowdhury

{"email":"Email address invalid","url":"Website address invalid","required":"Required field missing"}